সিএইসটি ডেস্কঃ
সরকার আমাদেরকে কথা বলতে দেয় না। আমাদেরকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আমরা পাহাড়ের সমস্যা নিয়ে এবং সমতলের আদিবাসীদের নানা সমস্যা নিয়ে দেশে বিদেশে নানা জায়গায় কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সেটাতে বাধা প্রদান করে এসেছে। বাংলাদেশের উপনিবেশ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাকিস্তান যেভাবে বাংলাদেশকে শাসন শোষণ করে এসেছে তার চেয়েও অধিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন শোষণ করে এসেছে এদেশের শাসকগোষ্ঠী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫তম বর্ষপূতি উপলক্ষ্যে শুক্রবার ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয়(সন্তু) লারমা এই মন্তব্য করেন।
“আমরা পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পার হয়ে এসেছি। এই সময়টা আমার জীবনের বৃথায় পার করে এলাম। যে সময়টাতে এই দেশের মানুষের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি কল্পে আরো কিছু অবদান রাখতে পারতাম, তা হল না। আমি গুনে গুনে এসব উপলব্ধি করতাম। কিন্তু ফলাফলহীন ছিল এই ২৫ টি বছর। এটা ছিল অবর্ণনীয় অনুভূতির ব্যাপার। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তো হলই না, বরং এই চুক্তি যেন মানুষ ভুলে যায় তার ব্যবস্থায় করেছে সরকার”,বলেন সন্তু লারমা।
“পাহাড়ে যেসব সশস্ত্র গ্রুপ আছে তাদের কারা সৃষ্টি করেছে তাদের নিয়ে কেউ জানতে চায় না।জনসংহতি সমিতিকে চিরতরে দমন করার জন্যই এসব গ্রুপগুলোকে সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই গ্রুপগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে, অন্যের প্রাণ হরণ করা হচ্ছে। তার খবর এদেশের শিক্ষিত মানুষ জানে না”, তিনি বলেন।
দীর্ঘ ৫২ টি বছর ধরে সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে চলছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, সম্পদ হানি থেকে শুরু করে লুঠতরাজ চলছে। পাহাড়ী মানুষ নিরাপত্তাহীন। যতদিন গণমুখি সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না ততদিন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হবে না”, বলেন সন্তু লারমা।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ে আন্দোলন জিইয়ে থাকবে দাবি করে সাবেক এই গেরিলা নেতা আরো বলেন, “এই চুক্তির পেছনে অনেক মানুষের রক্ত আছে। অনেক জুম্ম মা-বোনের নিপীড়ন ও সম্ভ্রম আছে। কাজেই এই চুক্তি পাহাড়ের মানুষ ভুলতে পারে না। এই চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে বৃহত্তর আন্দোলনের কথা ভাবা হচ্ছে। এই আন্দোলন কোন দিকে মোড় নিবে তা আমি জানি না।”
বৃহত্তর এই আন্দোলন দেশের সকল শিক্ষিত সমাজ ও গণমানুষকে সামিল হওয়ারও আহবান জানান তিনি।
পাবত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াই কেবল পাহাড়ীদের নয়। এটা সম্মিলিত একটি লড়াই উল্লেখ করে বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন বলেন, “আজ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে প্রথম যে ধারাটি ছিল সেটা হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হবে এবং তার বৈশিষ্ট সংরক্ষণ করা হবে। কিন্তু তা আজও হয়নি।”
“আশির দশকে নদীভাঙা ও চরভাঙা মানুষকে যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত করা হল তাই ছিল পাহাড়ের জনমিতি পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। এখন পাহাড়ের যে জনমিতি যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এইসব অভিবাসিত বাঙালিদেরকে পাহাড়ের বাইরে পুনর্বাসিত করার জেন্টলমেন্ট এগ্রিমেন্ট থাকলেও তা করা হচ্ছে না”, বলেন তিনি।
“ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত কোনো ভূমি বিরোধই নিষ্পত্তি করতে পারেনি। এটা পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন। পার্বত্য অঞ্চলকে নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখার যে চল জিয়াউর রহমান নিয়ে এসেছিলেন তা এখনো চলমান। যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার জায়গাটাতে পরিবর্তন আসবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত এই চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না”, বলেন রাশেদ খান মেনন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “২৫ বছর দীর্ঘ সময় । বিশেষ করে যারা অপেক্ষায় থাকে। পত্রিকায় অনেক কথা বলা হয়েছে। ১০০ টি ব্রিজ উদ্ধোধন করা হয়েছে, ঢাকায় কমপ্লেক্স হয়েছে, অনেক কালভার্ট হচ্ছে। একটি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদ হয়েছে। কিন্তু তার পরেও পাহাড়ী মানুষের মনে শান্তি নেই।”
“২৫ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন জেলা পরিষদ পরিচালনার জন্য কোনো বিধি হয়নি। আমাদের দেশে আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু বিগত ২৫ বছরেও কোনো বিধি বা আইন হল না। একটি সময়সূচি ভিত্তিক রোডম্যাপ যেন করা হয়। এই কর্মপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যেন আগামী প্রজন্মের জন্য নতুন কিছু করা হয়”, বলেন তিনি।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, “পার্বত্য চুক্তির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা প্রতিদিনের খবরে দেখি পাহাড়ে কি হচ্ছে। সেখানে সরকারী বেসরকারী স্থাপনার নামে আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সেখানে আজও নারীরা নিরাপদ নয়। পার্বত্য চুক্তি যেমন বাস্তবায়ন করছে না তেমনি এই সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন করছে না।”
“বাগদা ফার্মে আদিবাসীদের বাড়ীতে আগুন দিল, আলফ্রেড সরেনকে হত্যা করা হল, এরকম অসংখ্য ঘটনা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার নেই। সরকার আমাদের কোনো কথায় রাখেনি। তাই এই সরকারের উপর আমাদের কোনো বিশ্বাস নেই”, তিনি বলেন।
ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, “সাম্প্রদায়িকতা সবখানে রাজত্ব করছে। ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল তারও কোনো প্রতিফলন নেই। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা থেকে শুরু করে, লুটপাত, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচার যেন সমগ্র জায়গায়। যে দলটি ১৯৯৭ সালে চুক্তি করেছিল সে দলটিই আজ পর্যন্ত ক্ষমতায়। কেন চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা আজ সবাই জানে।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “আমি গত বছর চিম্বুক পাহাড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে পাঁচতারা হোটেল হচ্ছে। যারা করছে তারা খুব খুশি। কিন্তু পাহাড়ের নিচে যে আদিবাসী বন্ধুরা তাদের আছে কান্নার জল।”
আদিবাসীদের সাংবিধানিক ও নাগরিক স্বীকৃতি দাবি করে তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে দেখলাম, পার্বত্য ভূমি কমিশনের সভা হওয়ার আগে কারা যেন হরতাল ডাকলো আর স্থগিত করা হল সেই সভা। কেন ভূমি কমিশন কাজ করতে পারছে না তার দায়ও সরকারকে নিতে হবে। আমরা ২৫ বছরে রোডম্যাপ শুনতে চাই। এই চুক্তির কোন অংশ কবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা যেন সরকার পরিস্কারভাবে তুলে ধরে।”
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, “পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর প্রমাণ করেছিল আদিবাসী অধিকার স্বীকৃতিযোগ্য। এ চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি মিলেছিল। কিন্তু ২৫ বছরে আমরা এক দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।”
তিনি বলেন, “পাহাড়ের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। পাহাড়ে শান্তি কী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই প্রশ্ন রয়ে যায়। এই রাষ্ট্র পরিচালকরা কী শান্তি চান নাকি জিয়াউর রহমান ও এরশাদের মত রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব দিয়ে শাসন করবেন। এভাবে কেবল কর্তৃত্ব করা যায়, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।”
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, “পার্বত্য চুক্তির প্রথম যে শর্ত, এই অঞ্চল আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হবে। কিন্তু আজ সেখানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাজেই প্রথম কাজ হোক এই দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা।”
“সংসদে এই চুক্তি নিয়ে খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু আদিবাসীদের ভূমি দখলের অভিযোগ আছে।তাঁর কাছে পাহাড়ের আদিবাসীদের অধিকার কীভাবে সুরক্ষিত থাকে”,বলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্য খুশী কবির বলেন, “আমরা দেখছি এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে না গিয়ে দিন কে দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন নিজস্ব স্বত্তা নিয়ে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য কিছু মানুষের স্বার্থ আছে। সেখানে যেন তারা ভূমি গ্রাস করতে পারে। জোর করে, প্রলোভন দেখিয়ে যেসব সেটলারদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারাও সেখানে ভালো নেই।”
“সকল আদিবাসী নারীরা নিজ ভূমিতে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছে। এটা কোনো সভ্য দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না। পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থাটা ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে রাখা হয়েছে এবং ভূমি কমিশনের বিধিমালা এখনো করা হয়নি। যার জন্য কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হচ্ছে না”, তিনি বলেন।
উক্ত আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের দপ্তর সম্পাদক মনিরা ,সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা ।
More Stories
বাংলাদেশে আদিবাসীদের ভূমিতে কোয়ান্টামের নিরবচ্ছিন্ন দখল আক্রমণ
কেন বৌদ্ধ সমিতির প্রতি আস্থা হারিয়েছেন দায়ক দায়িকারা
‘বিপুল চাকমারা হাজারো বিপ্লবী জন্ম দিয়ে গেছেন’