November 22, 2024

Always worth looking into

বিচার চান না রেংয়ুং ম্রো

সিএইসটি ডেস্কঃ

আমার অনেক কষ্টের লাগানো বাগান ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রায় চার মাস আগে একটি সংস্থার এবং পাড়ার মানুষের সহযোগিতায় প্রায় তিনশ কলা গাছের চারা নিয়ে এই বাগান করেছিলাম। আশায় ছিলাম কয়েক মাস পর বাগানের কলা বিক্রি করে সংসারের অভাব দূর করব।

বলছিলেন বান্দরবানের লামা উপজেলার রেংয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার রেংয়ুং ম্রো।

“লামা রাবার কোম্পানির প্রায় ৪০-৪৫ জন শ্রমিক গত শনিবার  আমার বাগানের সব কলা গাছ কেটে দিয়েছে। আমার সব স্বপ্ন  শেষ করে দিয়েছে”, বলেন রেংয়ুং।

“কার কাছে বিচার চাইব। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, পুলিশ সবাই কোম্পানির লোক। এর আগে কোম্পানির লোকেরা আমাদের পাড়ার ঝিরিতে বিষ দিয়েছিল। এবার কষ্টের লাগানো গাছ কেটে দিয়েছে । এখন আর বিচার চাইনা”, আর্তনাদ করে বলেন রেংয়ুং।

“কোম্পানির লোকের ভয়ে আমরা একা কেউ পাশের বাজারে পর্যন্ত যাই না। প্রথমে তারা আমাদের জুম ভুমি পুড়িয়ে দিল। খাবার পানির উৎসে বিষ প্রয়োগ করল। আমাদের নামে মিথ্যা মামলা করল। দেশের মানুষের সহযোগিতায় পাওয়া গাছের চারাও কেটে দিল”, বলেন রেংয়েন পাড়ার কারবারি রেংয়েন ম্রো। 

রেংয়েন পাড়ায় ১১ ম্রো পরিবারের বসবাস জানিয়ে কারবারি বলেন “জানিনা কিভাবে টিকে থাকব। পাড়ার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কোম্পানির লোকেরা একটার পর একটা মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। আমদের আর্তনাদ সরকারের কানে পৌঁছে না।“

লাংকম পাড়ার কারবারি লাংকম ম্রো বলেন, আমাদের জুম ভুমি দখলের বিরুদ্ধে অজস্র প্রতিবাদ করলাম ,মানববন্ধন করলাম, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে স্মারকলিপি দিলাম। কিন্তু ভুমি দখলদার রাবার কোম্পানির বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নিল না। উল্টো আমাদের নামে মিথ্যা মামলা হল।”

“এই দেশ কি আমাদের নয়? আমরা কি কোনদিনও ন্যায় বিচার পাব না? জোড় করে কেন আমাদের ভুমি কেড়ে নেয়া হবে?”, বলেন লাংকম।

“আমাদের এলাকায় কোন স্কুল নেই। দেশের কিছু সচেতন মানুষের সহযোগিতায় এখানে একটা স্কুল করতে চেয়েছিলেন । সেখানেও সম্প্রতি আমাদেরকে বাধা দেয়া হয়েছে”, বলেন তিনি।

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃজাবেদ কায়সার বলেন “কলা গাছ কেটে দেয়ার ব্যাপারে কেউ এখনও অভিযোগ করেনি। যে জায়গায় স্কুল করতে চাচ্ছে সে ভুমি নিয়ে লামা রাবার বাগানের লোকেরা একটা অভিযোগ দিয়েছে। তাই আমরা পুলিশের মাধ্যমে আপাতত সেখানে স্কুল নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি।”

গত বুধবার, ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ,বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহকে জাতি হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পাহাড়িদের প্রথাগত আইন কানুনকে উপেক্ষা করে মুনাফা লোভীরা সেখানকার জাতিসত্তাসমূহকে অস্বীকার করে, ভূমির ওপর খবরদারি করে দখল করে বসে আছে। “

তিনি বলেন, রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ যে শর্তগুলো রয়েছে তা লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে দখল করে আছে। কিন্তু সেখানকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরবতা পালন করছে। কোম্পানীর পক্ষে পক্ষালম্বন করছে। পানিতে বিষ প্রয়োগ করে পানিতে মারার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা এই ঘটনায় রাবার ইন্ডাস্ট্রিজকে দায়ী করছি এবং এই ঘটনার সাথে জড়িতদের জনগণের আদালতে এনে বিচার করতে হবে।”

বৈঠকে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা বলেন, “লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কেবল অন্যায়ভাবে পাহাড়িদের জমি বেদখল ও উচ্ছেদের অপরাধে জড়িত নয়, এই কোম্পানি  প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্যও দায়ী। গত ২৬ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ আমাদের যে জুম ভূমি পুড়িয়ে দেয় সেখানে সে সময় পুরো প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যায়, বহু জীবের প্রাণ সংহার হয় এবং লাংকম পাড়ার ছড়া ও ঝর্ণার পানি বিষাক্ত হয়। এ কারণে বর্তমানে আমাদের এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে পড়েছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর রেংয়েন পাড়া এলাকার একমাত্র খাবার পানির  উৎস কলাইয়া ঝিরিতে বিষ প্রয়োগ করে কোম্পানির লোকেরা”

“এই সব  অপরাধে যাদের বিচার হওয়া উচিত সরকার ও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বরং তাদের পক্ষাবলম্বন করে চলেছে। অপরদিকে আমরা যারা ক্ষতির শিকার হয়েছি, নিজ ভূমিতে পরবাসীর মতো দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে, তাদের উপর হামলা করা হচ্ছে। আমরা তিন পাড়াবাসী এখন গ্রেফতার, হামলা ও উচ্ছেদের ভয় ও আতঙ্কে বাস করছি”, তিনি বলেন।

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর পরিচালক কামাল উদ্দিন বলেন, “আমরা কারও কলা বাগান কেটে দিইনি। মাস খানেক আগে পাড়াবাসীরা আমাদের অনেক রাবার গাছ কেটে দিয়েছিল। সেই ঘটনায় আমরা এগারো জন পাড়াবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। সম্প্রতি সেই মামলার একটা তদন্ত টিম সেখানে যাওয়ার কথা থাকলে তাদেরকে গাছের গোড়া দেখানোর জন্য আমরা জঙ্গল পরিষ্কার করেছিলাম।”

গত মার্চে বান্দরবান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে লাংকম ম্রো পাড়া কারবারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া, এবং রেংয়েন কারবারি পাড়ার বাসিন্দারা মানব বন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে তাদের দখল হয়ে যাওয়া ৪০০ একর জুম ভুমি ফেরতের আশায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন বলে জানান লাংকম পাড়ার বাসিন্দা ইনচং ম্রো।