সিএইচটি ডেস্কঃ
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড় এখন সারা দেশের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন।
মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চত্বরে চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে আয়োজিত সংহতি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
রাশেদ খান মেনন বলেন, “দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামেন মধ্য দিয়ে এই শান্তি প্রক্রিয়া আমরা শুরু করতে সক্ষম হয়েছিলা। কিন্তু এই পাহাড় এখন অশান্ত। শুধু তা নয় পাহাড়ের অশান্তিকে ঘিরে এই চট্টগ্রামে ও সারাদেশে অশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আপনারা দেখেছেন, গত কয়েকমাস ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে জঙ্গী মৌলবাদীরা সেখানে সশস্ত্র ট্রেনিং নিচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে হামলা চালানোর জন্য। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যুবকদের এনে ট্রেনিং দিয়ে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা তারা করেছিল। তাদের টার্গেট ছিল কাশিমপুর জেল। কারণ সেখানে জঙ্গিরা রয়েছে। অর্থাৎ পাহাড়ের অশান্তি এখন সারাদেশের অশান্তি।”
তিনি আরও বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার পান। আশা ছিল এই চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদাহরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তা হয়নি। বহুবার সরকারের কাছে আবেদন করেছি। ওই পার্লামেন্টে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন প্রণয়ন করার জন্য। যতবার পার্লামেন্ট থেকে আমরা বিবৃতি দিয়েছি ততবার আমলাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা হাজির করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল ভূমি কমিশন আইন করতে।
“৩০ হাজার আবেদন পড়েছে ভূমি কমিশনে, একটিও নিষ্পত্তি করা হয়নি। তাহলে যে আইনে সমস্যার সমাধানের কথা ছিল তা আমরা করছি না। জিয়াউর রহমান পার্বত্য সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নেয়। এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা সেদিন সাধারণ নিরীহ মানুষকে এনে অভিবাসী বানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসিয়ে দিয়েছিল। এ ঘটনার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরণে কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। শান্তি চুক্তিতে তাদের পুনর্বাসনের কথা ছিল”, বলেন মেনন।
“আজ এ বিষয় নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে কথা বলতে পারবেন না। আমরা যখন গেছি হরতাল দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। ড. কামাল হোসেন, ঐক্য ন্যাপ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্যসহ আমাদের আটকে দেয়া হয়। সেখানে গিয়েছিলাম ডিসি সাহেব বলেন, আপনারা বেশি আলোচনায় যাবেন না। আমি বললাম, চুক্তি সরকারের, দেশ সরকারের আর আপনি এ কথা বলছেন”, যোগ করেন মেনন।
“এই পাহাড় দেশের এক দশমাংশ। একদিন খালেদা জিয়া বলেছিল, চুক্তি করে এক দশমাংশ শেখ হাসিনা ভারতের হাতে তুলে দিবে। ৩০ বছর হয়েছে তা হয়নি। আজ যদি সরকারও একই যুক্তি দেয়, একই ধরণের বিচ্ছিন্নতার কথা বলেন, তাহলে পাহাড়ে শান্তি কখনো শান্তি আসবে না। শুধু পাহাড়ের মানুষ নয় মূল স্রোতের সব মানুষকে এ দাবিতে এক হতে হবে। পাহাড়ি বাঙালি মিলে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করব। এটা আমাদের দায়িত্ব” বলেন মেনন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এ সমাবেশের আয়োজন করেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন। এতে সভাপতিত্ব করেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ।
সভাপতির বক্তব্যে আবুল মোমেন বলেন, মূলধারার জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, সমর্থন, সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সহজে হবেনা। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রশ্নে নিরব। শুধু পাহাড়ে নয় সমতলেও আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের ভূমি হারাচ্ছে। বড় দলগুলোর এসব প্রশ্নে ভূমিকা দেখিনা। তারা আছে ক্ষমতা রক্ষা ও দখলের লড়াইয়ে। কিন্তু মানুষ আছে অন্যরকম সমস্যার মধ্যে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে নতুন জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে।

সিপিবি সভাপতি কমরেড শাহ আলম বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর হয়ে গেল। এখনো সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যে সরকার এই চুক্তি করেছে সে সরকার আজ ১৪ বছর ক্ষমতায়। তারা বাস্তবায়ন করছে না কেন? তাহলে সরকারের মধ্যে অন্য কোনো সরকার আছে কিনা? তারা কী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও বড়? না হলে কেন চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। চুক্তির সময় বিএনপি লং মার্চ করে বলেছিল, শান্তি চুক্তি করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। তা এখনো বাংলাদেশেই আছে। ভারত হয়নি। এটি একটি জিওপলিটিক্সের এলাকা।
তিনি বলেন, রাঙামাটির সাথে ভারতের যেমন সীমানা আছে, মিয়ানমারেরও আছে। আবার ওদিকে রোহিঙ্গা এসেছ।পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি রেখে দেশে শান্তি হবে? উন্নয়ন হবে? যে কোনো সময় তো আগুন জ্বলতে পারে। এখানে অশান্তি রাখলে নানা বিদেশি শক্তি এদের নিয়ে তো খেলবে। বাংলাদেশে শান্তি আসবে না। নানা রকম যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার আশঙ্কা আছে। এটি সরকারকে ভাবতে হবে।
তিনি আরও বলেন, চুক্তির সময় আপনারা এক ছিলেন। এখন নানা রকম বিভক্তি। রক্তক্ষয়ী অন্তর্ঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। হয়ত বাইরের শক্তি সেখানে হাত ঢুকিয়েছে। পাহাড়িদের ঐক্য আবার গড়ে তুলতে হবে। পাহাড়ি ও বাঙালির ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে বলব আগুন নিয়ে খেলবেন না। কোয়াডের সদস্য করতে বাংলাদেশকে আমেরিকা বারবার চাপ দিচ্ছে। আমেরিকা তো নানা ভাবে খেলতে পারে। সরকারের মধ্যে যে সরকার আছে ওখানেও আমেরিকার সোর্স থাকতে পারে। যারা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না। এই ভূরাজনৈতিক খেলা থেকে বের হতে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিলম্বে চুক্তি বাস্তবায়ন করা দরকার।
ওয়ার্কার্স পার্টি চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বাসদ সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক রণজিৎ দে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সৌখিন চাকমা, জাসদ কেন্দ্রীয় নেতা জসিম উদ্দিন বাবুল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ঐক্য ন্যাপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুন রশিদ ভুঁইয়া, ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠুল দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য অ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের প্রতিনিধি অলিক মৃ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা প্রমুখ।
More Stories
বাংলাদেশে আদিবাসীদের ভূমিতে কোয়ান্টামের নিরবচ্ছিন্ন দখল আক্রমণ
কেন বৌদ্ধ সমিতির প্রতি আস্থা হারিয়েছেন দায়ক দায়িকারা
‘বিপুল চাকমারা হাজারো বিপ্লবী জন্ম দিয়ে গেছেন’